মহাকাব্যের মহানায়ক চরিত্রের মতেই ক্রিকেট বিশ্বের কিংবদন্তী মাহেন্দ্র সিং ধোনি এর ক্রিকেট ক্যারিয়ার। সফল অধিনায়ক, ঠান্ডা মস্তিষ্কের খেলোয়ার, কুল ক্যাপ্টেইন ছাড়াও বেস্ট ফিনিশার সহ বিভিন্ন নামে তাকে চিনে ও জানে পুরো ক্রিকেট বিশ্ব। তার ক্যারিয়ারে আছে ‘রাজীব গান্ধী খেলরত্ন’ পুরষ্কার, দেশের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান ‘পদ্মশ্রী’ সহ অসংখ্য পুরষ্কার এবং ভারতের বিশ্বকাপ জয়ী অধিনায়কের খেতাব।
ধোনির জন্ম ও শৈশব:
এম. এস ধোনির জন্ম ১৯৮১ সালের ৭ জুলাই, ভারতের ছাড়খন্ড রাজ্যের রাজধানী রাঁচিতে। তার বাবার নাম পান সিং ও মায়ের নাম দেবকী। তার বাবা স্টিল কম্পানীতে চাকরি করতেন। তার মা ছিলেন একজন গৃহিণী। পরিবারে তিন ভাইবোনের মধ্যে মাহেন্দ্র সিং ধোনির অবস্থান সবার ছোট। ছেলেবেলা থেকেই তিনি ছিলেন খেলাধুলার প্রতি প্রবল আকৃষ্ট।
ক্রিকেটের প্রতি ধোনির খুব একটা মন ছিল না। তার প্রিয় খেলার ভিতরে ফুটবল ছিল অন্যতম এবং তিনি ফুটবলের একজন গোলরক্ষক হতে চেয়েছিলেন। তার ক্রিকেট খেলা শুরু হয় স্কুলের ক্রিকেট টিম থেকে।
স্কুলের ক্রীড়া শিক্ষক ধোনির ফুটবলের গোলরক্ষন দেখে মুগ্ধ হন এবং তাকে ক্রিকেট উইকেট রক্ষক হওয়ার জন্য প্রস্তাব দেন। কিন্তু মাহেন্দ্র সিং ধোনি সে প্রস্তাবে রাজি হন নি। পরবর্তীতে যখন ক্রীড়া শিক্ষক আবার বলেন তখন তিনি রাজি হন। তাকে স্কুল টিমের উইকেট-রক্ষরে দায়িত্ব দেয়া হয়।
কিন্তু ধোনি তাতেই খুশি ছিলেন না। এরপর ধোনি ক্রিকেট খেলা শুরু করলো কিন্তু সে ব্যাটিং করার কোন সুযোগই পেতেন না কখনো। তার ক্রীড়া শিক্ষক তাকে সর্বক্ষণ উইকেট রক্ষক হিসেবে দেখতো।
কিন্তু যদি কোনদিন ক্রীড়া শিক্ষক প্রাক্টিসে আসতে দেরি করত তখন ধোনি ব্যাটিং প্র্যাকটিস করত। এভাবে করতে করতে একদিন একটি ম্যাচের মাধ্যমে ধোনির ব্যাটিং প্রতিভা কিছুটা প্রকাশ পায়। পরবর্তীতে ধোনি একটি ম্যাচে ওপেনিং ব্যাট করার জন্য অনুরোধ করেন এবং সেই ম্যাচে দুইশত এর অধিক রান করেন তিনি। সেই থেকেই তার ব্যাটিং এর শুরু।
চাকরিতে মাহেন্দ্র সিং ধোনি:
যখন অনেক জায়গায় অনেক চেষ্টা করেও ধোনি জাতীয় দলে চান্স পায় না। এর কারণ ছিল তার পারিবারিক অসচ্ছলতা। একদিন ভাগ্যক্রমে রেলওয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ধোনিকে রেলওয়েতে চাকরি করার প্রস্তাব দেয়। যেহেতু সরকারি চাকরি ছিল তাই মধ্যবিত্ত পরিবার হিসেবে তার পরিবারের সবাই রাজি ছিল চাকরির জন্য।
সকলের মুখে হাসি দেখার জন্য চাকরিতে যোগদান করেন ধোনি। কিন্তু তার মনে ছিল ক্রিকেট। তাই সে রেলওয়েতে যোগদান করেও ক্রিকেটের নেশায় মগ্ন ছিল।
অবশ্য তার এই ক্রিকেট খেলার পিছনে রেলের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার অনেক সহযোগিতা ছিল। কিন্তু তার এই ক্রিকেট খেলা কোন কোন কর্মচারীর পছন্দ হয়নি এবং তারা ধোনির নামে কমপ্লেইন করে । একপর্যায়ে ধোনি রেলওয়ের চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন এবং চলে যান তার গ্রামে।
অবশ্য তার এই সিদ্ধান্তে তার বাবা ছিলেন খুবই অসন্তুষ্ট। কিন্তু মাহেন্দ্র সিং ধোনির বিশ্বাস ছিল সে ক্রিকেটে অনেক ভালো কিছু করতে পারবে তাই সে আবার ক্রিকেট খেলার প্রতি মনোযোগ দেন।
আন্তরর্জাতিক ক্রিকেটে মাহেন্দ্র সিং ধোনি:
পরবর্তীতে ধোনি অনূর্ধ্ব ১৯ ক্রিকেট টিমে চান্স পায়। এখান থেকেই তার ক্রিকেট ক্যারিয়ারের শুরু। অনূর্ধ্ব ১৯ ক্রিকেটে ভালো পারফর্ম করার কারেনে সে জাতীয় টিমেও চান্স পেয়ে যান।
তার ভারতের জাতীয় টিমে অভিষেক হয় বাংলাদেশের বিপক্ষে। অভিষেক ম্যাচেই সে শূন্য রানে আউট হয় এবং প্রথম চার ম্যাচে সে মাত্র ২২ (০,৭,১২,৩) রান করেছিল। তিনি পঞ্চম ম্যাচে পাকিস্তানের সাথে ১৮৩ রানের এক অসাধারণ ইনিংস খেলে পুরো ক্রিকেট বিশ্বকে চমকে দেন।
এরপর থেকে ধোনিকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। তার খেলার সুনিপুন কৌশল সবাইকে মুগ্ধ করছিলো। এরপর কেবল তার অর্জনই চোখে পড়ে। তিনি ধারাবাহিক পারফর্মেন্স এর মাধ্যমে নিজেকে নিয়ে গেছে এক অনন্য উচ্চতায়। ভেঙেছেন ও গড়েছেন একের পর এক রেকর্ড।
ধোনির জীবনে নুতন অধ্যায়ের সূচনা হয় ২০০৭ সালে যখন তিনি ভারতীয় জাতীয় দলের অধিনায়কত্ব পান। অধিনায়ক হওয়ার পর ধোনির ক্যারিয়ারে যোগ হয়েছে আরও একাধিক পুরষ্কার ।
২০০৮ ও ২০০৯ সালে একদিনের ক্রিকেটে আইসিসির বর্ষসেরা খেলোয়ারের পুরষ্কার পান। এছাড়াও ২০০৯ সালে ধোনি ফোর্বস ম্যাগাজিন এর বিশ্বসেরা ১০ ধনী ক্রিকেটারের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় হিসেব মনোনীত হন। ২০১০ সালের ৪ জুলাই ধোনি কলকাতার মেয়ে সাক্ষী রাওয়াতকে বিয়ে করেন। যিনি ছিলেন হোটেল ম্যানেজমেন্ট এর স্টুডেন্ট।
মাহেন্দ্র সিং ধোনির অবসর:
অবশেষে সারা ক্রিকেট বিশ্বকে কাঁদিয়ে ২০২০ সালের ১৯ আগষ্ট তিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নেন। কিন্তু তিনি একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর আগে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে টেস্ট ক্রিকেট থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে অবসর গ্রহন করেন। নিউজিল্যান্ড এর বিপক্ষে ২০১৯ সালের বিশ্বকাপ সেমিফাইনালের ম্যাচটি ছিল ধোনির ক্রিকেট জীবনে শেষ ম্যাচ।
আরও পড়ুনঃ লিওনেল মেসি ফুটবল যাদুকর এর জানা অজানা তথ্য
মাহেন্দ্র সিং ধোনির সন্মাননা ও পুরস্কার:
- ২০০৮ সালে আইসিসি ক্রিকেট বর্ষসেরা খোলোয়ারে পুরস্কার পায়।
- ২০১৯ সালে পদ্মশ্রী উপাধি।
- ২০১৪ সালে এশিয়ান অ্যাওয়ার্ড জয়।
জাতীয় দল হয়ে ধোনির অর্জন:
২০০৭ সালে ক্যাপ্টেন হিসেব টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়।
২০১১ সালে ক্যাপ্টেন হিসেবে ওয়ানডে বিশ্বকাপ জয়।
২০১৩ সালে ক্যাপ্টেন হিসেবে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জয়।
২০০৮ সালে ক্যাপ্টেন হিসেবে অস্ট্রেলিয়া সিরিজ জয়।
২০০৮, ২০০৯ সালে আই সি সি প্লেয়ার অফ দ্যা ম্যাচ।
২০১০ সালে এশিয়া কাপ জয়।
তিনি ক্রিকেট ইতিহাসের অধিনায়ক হিসেবে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ জয় করেন। এছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন গৌরবময় অর্জন।
জাতীয় দল ছাড়াও IPL -এ সমান ভাবে সফল মাহেন্দ্র সিং ধোনি। ২০০৮ সালে “চেন্নাই সুপার কিংস” তাকে কিনে নেয়। ওই বছর IPL -এ সবচেয়ে দামি খেলোয়ার হিসেবে গন্য হয় ধোনি।
IPL এ মাহেন্দ্র সিং ধোনির আর্জন:
২০১০, ২০১১ এবং ২০১৮ সালে চেন্নাই সুপার কিংস এর হয়ে শিরোপা জিতেন ধোনি।
মাহেন্দ্র সিং ধোনির সংক্ষিপ্ত পরিসংখান:
[table id=5 /]
ছবিঃ সংগৃহীত