মাছে ভাতে বাঙ্গালি- কথাটি বহুকাল ধরেই আমাদের মধ্যে প্রচলিত। আসলে নদীবিধৌত এই অঞ্চল প্রাচীনকাল থেকেই মাছ উৎপাদনে ছিল অদ্বিতীয়। এদেশের মধ্য দিয়ে জালের মতো বয়ে চলা নদী, খাল, বিল, গ্রামের পুকুর, ডোবা, দক্ষিণে বিশাল বঙ্গোপসাগর, সবই একসময় অসংখ্য প্রজাতির প্রচুর দেশীয় মাছ -এ ভরপুর ছিল। এসকল নদ-নদীতে যেমন মিঠাপানির মাছ বাস করতো, তেমন বঙ্গোপসাগরে লোনাপানির মাছ পাওয়া যেত। সুতরাং এ অঞ্চলের মৎস্য সম্পদে একসময় অসাধারণ বৈচিত্রের সমাহার পরিলক্ষিত হতো।
কিন্তু গত শতক, বা তার কিছু আগে থেকে মানুষের নানা কর্মকান্ডের প্রভাবে অনেক দেশীয় মাছে এর প্রজাতি এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। এখন বাজারে গেলে চাষের মাছই বেশি দেখা যায়। ছোট-বড় দেশীয় মাছ প্রায় দেখা যায় না বললেই চলে।
সরকারি তথ্য মতে আমাদের দেশের নদীনালা জলাশয় গুলোতে প্রায় ২৬০ প্রজাতির স্বাদুপানির মাছ রয়েছে। আইইউসিএন এর ২০০০ সালের গবেষণার তথ্যমতে ৫৪ প্রজাতির মাছ এখানে বিপন্ন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
পরে ২০১৫ সালের আরেকটি গবেষণার তথ্যমতে আরো ৬৮ প্রজাতির মাছ এই তালিকার অন্তর্ভুক্ত হয়। এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত মাছসমূহকে গত ১০ থেকে ২০ বছরে দেশে কোথাও দেখা গেছে বলে জানা যায় নি। এর মধ্যে ১২ প্রজাতির মাছ ভয়ঙ্কর বিপদাপন্ন এবং ২৮টি প্রজাতিকে বিপদাপন্ন হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
এককালে দেশে প্রায় সব নদীতেই বাঘাইর মাছের দেখা মিলত। সেই সাথে পিপলা শোল, দেশি মহাশোল, চান্দা, খরকি, গজার, কাকিলা, খলিসা, মেনি, রায়েক এই সব মাছ গত শতকের মাঝামাঝি সময়েও প্রচুর পরিমাণে ধরা পড়েছে। কিন্তু এখনকার সময়ে এসব মাছের কথা আমরা প্রায় ভুলতেই বসেছি।
আর্টিকেলে যা থাকছেঃ
এক সময় ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, ধরলা এই সব নদী ও এর শাখাসমূহে দেশীয় মাছ বৈরালী বা বরালী মাছ প্রচুর পরিমাণে ধরা পরতো। কিন্তু নদীতে বাধপ্রদান, নদী শুকিয়ে যাওয়া, অবাধে পোনা উত্তোলন ইত্যাদি কারনে এখন এই মাছ প্রায় বিলুপ্ত। আন্তর্জাতিক পরিবেশ সংরক্ষন বিষয়ক সংস্থা (আইইউসিএ) থেকে ২০১৫সালে এই প্রজাতিটিকে বিলুপ্তপ্রায় ঘোষণা করা হয়। মৎস্যবিজ্ঞানীদের বিস্তর গবেষণার ফলে পুকুরে এই মাছটির চাষ পদ্ধতি উদ্ভাবন করা সম্ভব হয়েছে। এতে করে এই প্রজাতিটিকে হয়তো বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশের বিলুপ্তপ্রায় আরেকটি দেশীয় মাছ হলো বাচা মাছ। এই প্রজাতির কাছাকাছি আরো দুটি মাছ হলো বাতাসি, কাজলি। এসব অতি সুস্বাদু মাছের কথা এখন শুধু পুরোনো দিনের মানুষদের কাছেই শোনা যায়। বর্ষার শুরুতে এসব মাছ ডিম ছাড়ার জন্য বিভিন্ন হাওড়, বাওড় এবং বিলে চলে যায়
বর্ষার শেষের দিকে আবার নদীগুলোর মূল প্রবাহে ফিরে আসে। এখন হাওড়, বিল প্রভৃতি সব ভরাট হয়ে যাওয়া, নদীর নাব্যতা হ্রাস, কৃ্ষিজমিতে অতিরিক্ত কিটনাশকের প্রয়োগ, প্রভৃতি কারনে এই সুস্বাদু ও পুষ্টিকর মাছের প্রজাতিটি দেশ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে।
আরেকটি বিলুপ্তপ্রায় দেশীয় মাছ হলো গুতুম। এরা পানির বাইরেও বেশ কিছুক্ষন বেচে থাকে। কাঁটা কম থাকায় এই মাছটি অনেকের কাছে সুবিধাজনক। তা ছাড়া পুষ্টিগুন ও স্বাদের দিক থেকেও এটি বেশ জনপ্রিয় ছিল। এককালে বাংলাদেশের প্রায় সব জেলাতেই এই মাছ পাওয়া যেত। এখন প্রায় দেখাই যায় না।
বাংলাদেশের স্বাদুপানির আরেকটি অনন্য বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন মাছের প্রজাতি হলো থুইট্টা। এই মাছের ঠোঁটের নিচের চোয়াল অনেকটা লম্বা কিন্তু উপরের চোয়াল ছোট এবং ত্রিকোনাকার। নদীর পানির উপরিস্তরে বসবাস করে এই মাছ। পুষ্টিগুনে এই মাছও কম নয়। বর্তমানে এই মাছও প্রায় হারিয়ে যাবার পথে।
বাঘাইর এক সময় এই অঞ্চলে বড় মাছ হিসেবে খুব জনপ্রিয় ছিল। এই প্রজাতির কিছু মাছ আকারে ও ওজনে বিশাল দানবাকৃতির হতো। নির্বিচারে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে মাছ ধরা এই মাছের প্রজাতিকে অনেকটা হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। বর্তমানে এই মাছ বাংলাদেশে বেশ সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে।
গ্রামাঞ্চলে একসময় জনপ্রিয় মাছসমূহের মধ্যে আরেকটি হলো খলিসা বা খোলসে। এটি মূলত দক্ষিন এশিয়ার একটি স্থানীয় মাছ। মিঠা পানির জলাশয়ে মূলত পুকুর, খাল, বিল, নদী, ঝরনায় একসময় এই মাছ প্রচুর পরিমানে পাওয়া যেত। কৃষি জমিতে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ও রাসায়নিক সার প্রয়োগ, জলাশয়ের পানিতে দূষণের মাত্রা বৃদ্ধি প্রভৃতি কারনে এই মাছ এখন বিলুপ্তির পথে। তবে কৃ্ত্রিমভাবে এই মাছ চাষের উদ্যোগ গ্রহনের ফলে কিছুটা হয়েও রক্ষা পেয়েছে এই প্রজাতি।
বাংলাদেশের আরেকটি বিপদাপন্ন মাছ মেনি। অনেক অঞ্চলে এটি ভেদা বা রয়না মাছ বলেও পরিচিত। এটি নদ-নদী, খাল বিল, হাওড় বাওড় সর্বত্রই বেচে থাকতে পারে। এটি একটি মাংসাসী মাছ। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউট আরো কিছু মাছের মতো এই মাছেরও কৃ্ত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উৎপাদনে সাফল্য অর্জন করেছে। তবে শুধু কৃত্রিম ভাবে হলেই হবে না, প্রাকৃ্তিকভাবেও এদের সংখ্যা বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিতে হবে।
মহাশোল বাংলাদেশের একটি মহাবিপন্ন প্রজাতির মাছ। এই দেশীয় মাছটি উচু পাহাড়ি এলাকার নদী বা ঝরনায় পাওয়া যায়। ভারতের উত্তরবঙ্গে, তিস্তা নদীর অববাহিকায়, বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে ও চট্টগ্রামের পাহাড়ি কিছু নদীতে আগে এই মাছের মিলত।
বর্তমানে এই মাছ শুধু বাংলাদেশেই নয় পার্শ্ববর্তী অন্যদেশগুলোতেও বিপদাপন্ন অবস্থায় রয়েছে। মহাশোল নাম হলেও মাছটি মোটেও শোল মাছের মতো দেখতে নয়, সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রজাতির। অনেকটা বড় রুই বা মৃগেল মাছের মতো এর আকৃ্তি। একারনে অনেকের মনে কিছুটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। বেশ সুস্বাদু এই মাছটি প্রায় হারিয়ে গেছে আমাদের দেশের নদ-নদীগুলো থেকে।
ফলি বা ফলুই আমাদের দেশের আরেকটি সংকটাপন্ন মাছ। এটি দেখতে অনেকটা চিতল মাছের মতো। মিঠাপানির ফলিমাছ একসময় নদীনালা, খাল-বিলে এই মাছ প্রচুর পরিমানে দেখা গেলেও এখন আর তেমন দেখা যায় না।
বামোশ আরেকটি দেশীয় মাছ যেটি এখন প্রায় হারিয়ে যাচ্ছে। এ মাছটি দেখতে অনেকটা সাপের মতো লম্বা। অনেক পুষ্টিগুন সম্পন্ন এই মাছটি এখন আর তেমন দেখা যায় না। দেখতে অনেকটা কুচিয়া মাছের মতো হলেও এটি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রজাতি। এটি অনেক সময় বিভিন্ন উদ্ভিদ খেতে ডাঙ্গায় উঠে আসে এবং অনেকক্ষণ ডাঙ্গায় বেচে থাকতে পারে। শরীর থেকে নিসৃ্ত একপ্রকার পিচ্ছিল পদার্থ দ্বারা এরা কাদার ওপর চলার পথ তৈ্রি করে। অনেক সময় পানিপূর্ণ চাষের জমিতে এদের পাওয়া যায়।
সুস্বাদু ও সুদৃশ্য একটি ছোট মাছ দারকিনা। একসময় নদী নালা, খাল-বিল, পুকুর –ডোবায় সব থেকে বেশি হয়তো এজাতীয় মাছই চোখে পড়তো। এরা লম্বায় হয় এক থেকে দেড় ইঞ্চি। এর মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত একটি লম্বা কালো দাগ থাকে। ছোট এই মাছটি অনেক প্রাণীর খাদ্যজালের সাথেই জড়িয়ে আছে। তাই এটি হারিয়ে যাবার সাথে সাথে আরো অনেক প্রাণীরই খাদ্যাভাব দেখা দিতে পারে।
গত শতকের শেষের দিকেও দেশের বিভিন্ন নদীগুলোতে অনেক প্রজাতির দেশীয় মাছ এর দেখা মিলত। এরপর কৃষিজমিতে অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও বিষাক্ত কিটনাশক প্রয়োগ, বাজারের চাহিদা মেটাতে অতিরিক্ত পরিমান মৎস্য নিধন, জলাশয় ভরাট করে ফেলা প্রভৃতি কারনে বেশির ভাগ দেশি মাছের প্রজাতি বিলুপ্তপ্রায়। ইলিশমাছও একসময় কমে যেতে আরম্ভ করেছিল। কিন্তু সরকারও জনগনের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই মাছের উৎপাদন আবার বাড়ানো সম্ভব হয়েছে।
কৃ্ত্রিমভাবে মাছের পোনা উৎপাদন ও চাষের পদ্ধতি আবিষ্কার করে হয়তো সেই সব মাছের উৎপাদন অনেক বাড়ানো সম্ভব যেগুলোর বাজারে যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। কিন্তু বাজারে চাহিদা কম, এমন মাছের প্রজাতিকেও রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব। আর সেজন্য প্রয়োজন সকল শ্রেণি ও পেশার মানুষের মাঝে এ বিষয়ে সচেতনতা বোধ জাগ্রত করা।
মন্তব্য লিখুন