রাজনৈতিক নেতাদের বিভিন্ন ধরনের স্থলন দেখতে জনগণ অভ্যস্থ। তবে সকল ধরনের স্থলনের মধ্যে যৌন কেলেঙ্কারি সবচেয়ে ভয়াবহ। পৃথিবীতে এমন অনেক বাঘা বাঘা ব্যক্তি রয়েছেন যাদের উজ্জ্বল রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ, প্রভাব-প্রতিপত্তি, আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা এক মুহুর্তে ধুলোয় মিশে গেছে যৌন কেলেঙ্কারির ঘটনায়।
জনগণের মনস্তত্ত্ব এমন যে তারা অনেক কিছু মেনে নিলেও নারী ঘটিত কোনো বিষয়ে কারো নাম জড়ালে তাকে আর স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেন না। পৃথিবীতে এমন অনেক বিখ্যাত মানুষ রয়েছেন যাদের সারাজীবনের সকল সুনাম এক মুহুর্তেই একটি নারী ঘটিত যৌন কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে ম্লান হয়ে গিয়েছে। আজকে আমরা গত দশকে আলোচিত কয়েকটি যৌন কেলেঙ্কারি সম্পর্কে জানবো।
গণধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত আইএমএফের প্রধান দোমিনিক
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (
আইএমএফ) সাবেক প্রধান
দোমিনিক স্ট্রাউস কানের বিরুদ্ধে উঠেছিলো গণধর্ষণের অভিযোগ। ২০১২ সনের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে একটি সেক্সপার্টিতে অংশগ্রহণ করে এই গণধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত হন তিনি। এর আগে ২০১১ সনে নিউইয়র্কে একটি হোটেলে এক পরিচারিকাকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। যখন এই মামলা চলছিলো ঠিক সেসময়ে ফ্রান্সের এক নারী সাংবাদিকও আদালতে তার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করেন।
স্ট্রাউস কানের বিরুদ্ধে যিনি অভিযোগ আনেন তার নাম ছিলো নাফিসাতু দিয়াল্লো ৷ নাফিসাতুর অভিযোগ ছিল স্ট্রাউস কান নিউইয়র্কের সোফিটেল হোটেলে তাঁকে মেরে ‘ওরাল সেক্স’-এ বাধ্য করেছিলেন৷
চারিদিকে যখন এই খবর রটে যায় তখন স্ট্রাউস নিজের দেশ ফ্রান্সে ফেরার জন্য জন এফ কেনেডি এয়ারপোর্টে গিয়ে বিমানে উঠেছেন। বিমান থেকেই তাকে আটক করেন যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ৷ শুরুতে অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করলেও পরে তিনি গোপনে ক্ষতিপূরণ দিয়ে বিষয়টি মিটমাট করে নেবার গোপন চেষ্টা করেছিলেন। পরবর্তীতে এই যৌন কেলেঙ্কারির কারণে আইএমএফ প্রধানের পদ ছাড়তে বাধ্য হন তিনি৷ কান পরে এটাকে তার নৈতিক ব্যর্থতা বলে স্বীকার করেছিলেন।
পেন স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সিরিয়াল ধর্ষক কোচ
শিক্ষকদের মাধ্যমে যৌন কেলেঙ্কারি এর ঘটনা সচারাচর আমরা ঘটতে দেখি। কিন্তু একজন ফুটবল দলের কোচ রূপান্তরিত হয়ে উঠেছিলেন সিরিয়াল ধর্ষকে। ঘটনাটি যুক্তরাষ্ট্রে পেনসিলভানিয়ার পেন স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানের ফুটবল দলের সাবেক মার্কিন ফুটবল কোচ জেরি সানডাস্কি শিশু যৌন নিপীড়নের ৪৮ টি অভিযোগে অভিযুক্ত হন। এই অভিযোগগুলোর মধ্যে ৪৫ টি ঘটনায় আদালত তাকে দোষী সাব্যস্ত করে।
তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিলো তিনি ১৫ বছর ধরে ১০ জন বালককে ৪৮ বার যৌন নিপীড়ন করেছেন। কিন্তু ৬৮ বছর বয়স্ক সানডাস্কি এ অভিযোগ অস্বীকার করলেও আদালত তাকে জেলে পাঠান এবং এক মুহুর্তে ফুটবল কোচ হিসেবে তার সকল কীর্তি মুছে গিয়ে তিনি এখন একজন ধর্ষক হিসেবেই পরিচিত।
নিজের পুরুষাঙ্গের ছবি পাঠিয়ে ফেসে যাওয়া ডেমোক্র্যাটিক নেতা
অতিসাম্প্রতিক ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নেতা অ্যান্থনি ওয়েইনার যৌন কেলেঙ্কারি-তে অভিযুক্ত হয়েছিলেন। নিজের শিশু সন্তানের সাথে শুয়ে আছেন এমন একটি সেলফি তিনি একজন নারীকে পাঠান আর তাতেই ঝামেলার শুরু। মূলত এই ছবিতে তিনি এমন একটি অঙ্গকে ফোকাস করে ছবি তুলেছিলেন যা এক ধরনের যৌন নিপীড়নই।
পরবর্তীতে ২০১১ সাল থেকে তিনি অন্তত ছ’জন মহিলাকে ছবি ও মেসেজ পাঠিয়েছেন বলে স্বীকার করেছিলেন। এই অভিযোগের পরে ১৫ বছরের একটি মেয়ের সঙ্গে তাঁর যৌন সম্পর্কের ঘটনাও সামনে আসে। এইসব কারণে তিনি রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হন এবং তাঁকে যৌন পুনর্বাসনে পাঠানো হয়।
বার বার নারী কেলেঙ্কারিতে জড়ানো ইতালির প্রধানমন্ত্রী সিলভিও বার্লুসকোনি
বিপুল সমর্থন নিয়ে ১৯৯৪ সালে প্রথম প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছিলেন বার্লুসকোনি। মাঝে বিরতি দিয়ে এরপর আরো দুই বার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন ৭৫ বছর বয়সি এই ব্যবসায়ী। কিন্তু দুর্নীতি ও যৌন কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে তার বিদায়ের চিত্র ছিলো ক্ষমতায় আরোহণের ঠিক বিপরীত।
‘মিডিয়া মুঘল’ হিসেবে পরিচিত ইতালির এই ধনকুবের প্রধানমন্ত্রী হলেও নিজের অভ্যাসকে মোটেও বদলাতে পারেন নাই । নিজের রোমের বাড়িকে ‘প্রমোদ ভবন’ বানিয়ে ব্যাপক সমালোচিত হয়েছিলেন তিনি। দুর্নীতি ও যৌন কেলেঙ্কারির চারটি মামলায় নিয়মিত আদালতে হাজিরাও দিতে হতো ইতালির সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে।
আরও পড়ুনঃ
বার্লুসকোনি সব সময়ই নারীসঙ্গ উপভোগ করতেন। স্বভাবজাত অভ্যাসেই তিনি সম্পর্ক গড়ে তোলেন সেসময়ের আলোচিত রুবি নামের একজন মডেলের সাথে।
২০১০ সনে বার্লুসকোনির বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, তিনি মরক্কোয় জন্ম নেওয়া রুবি নামে পরিচিত মডেল কারিমা এল মাহরুর সঙ্গে পার্টিতে রাত কাটিয়েছেন। ওই সময় রুবির বয়স ছিল ১৭ বছর। ইতালিতে পতিতাবৃত্তি বেআইনি না হলেও অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের সাথে যৌনসংসর্গ ভয়াবহ রকমের অপরাধ।
রুবি এবং বার্লুসকোনিও দুইজনেই পার্টিতে নিজেদের উপস্থিতির কথা স্বীকার করলেও যৌন সম্পর্কের কথা অস্বীকার করেছিলেন। পরবর্তীতে বিচার বিভাগীয় তদন্ত শুরু হয় এবং একটা সময়ে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বার্লুসকোনিও পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
সংসদে বসে পর্ন দেখে বরখাস্থ হওয়া সাংসদ
সংসদ ভবন নাগরিকদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র জায়গার নাম। এখানে সাংসদরা বসেন এবং দেশের জন্য আইন পাস করেন। সারাদেশের জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন তারা। কিন্তু এই সংসদে বসে পর্ন দেখার মতো ঘটনায় জড়িয়েছেন অনেক দেশের সাংসদেরা এবং হয়েছেন বরখাস্ত।
ইন্দোনেশিয়া পৃথিবীর মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের নাম এবং দেশটিতে অনেক ধরনের রক্ষণশীল আইন রয়েছে। সংসদ চলাকালীন সময়ে সেখানে বসে পর্ন দেখারত অবস্থায় ক্যামেরায় ধরা পড়েন আরিফিন্তো নামের এই দেশের একজন সাংসদ।
প্রচন্ড সমালোচনার মুখে পড়ে তিনি পদত্যাগ করেন এবং তাকে পরবর্তী ৩০ দিন বাধ্যতামূলক কোরান খতমের সাঁজা দেওয়া হয়। এই বছর মার্চে একই ঘটনায় অস্ট্রেলিয়ার চারজন সরকারি কর্মকর্তাকে বহিষ্কার করা হয়। সংসদে বসে তারা চারজন সেক্স ভিডিও দেখছেন এমন একটি ভিডিওক্লিপ প্রচার করে সেদেশের টেলিভিশনগুলো। ব্রিটনি হিগিনস নামে এদেশের একজন কর্মকর্তা অভিযোগ এনেছিলেন ২০১২ সনে তারই একজন সহকর্মী কর্তৃক সংসদ ভবনের মধ্যে তিনি ধর্ষণের শিকার হন।
কিশোরীর সাথে যৌনতার দায়ে যুবরাজের পদত্যাগ
রানি এলিজাবেথের দ্বিতীয় পুত্র প্রিন্স এন্ড্রু। ২০১৯ সনে তার বিরুদ্ধে কিশোরীর সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের অভিযোগ ওঠে এবং তিনি তার রাজকীয় সকল দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিতে বাধ্য হন।
অভিযোগ ছিলো ৫৯ বছর বয়সী যুবরাজ একজন ১৭ বছরের কিশোরীর সঙ্গে যৌনকর্ম করেছেন৷ এই ঘটনায় উঠে আসে এপেস্টেইন নামে আরেকজনের কথা যিনি ছিলেন যুবরাজের বন্ধু। অভিযোগ ছিলো এপেস্টেইনই এই কিশোরীকে যুবরাজের মনোরঞ্জনের জন্য নিয়ে এসেছিলেন। পরবর্তীতে যৌনতার উদ্দেশ্যে পাচারের অভিযোগে অভিযুক্ত এপেস্টেইন জেল খানায় বসে আত্মহত্যা করেন।
যৌন নির্যাতনে অভিযুক্ত সৌদি যুবরাজ মাজেদ
সৌদি আরবের প্রিন্সদের ভোগ বিলাসের জীবন যাপন সম্পর্কে বর্তমানে সবাই জানেন। ২০১৫ সনে বৈরুতের রফিক হারিরি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ব্যক্তিগত বিমানে দুই টন মাদকদ্রব্যসহ এক সৌদি যুবরাজকে আটক করেছিলো লেবানন পুলিশ।
এছাড়াও একই বছরে যুক্তরাষ্ট্রে গৃহকর্মীর উপর যৌন নির্যাতনের অভিযোগ আসে আরেক যুবরাজের উপর। অভিযোগকারীরা জানান, নিয়োগের প্রলোভনে তাদের তিনজনকে বাসায় আটকে রেখে যৌন নির্যাতন ও মাদকগ্রহণে বাধ্য করেন এই যুবরাজ।
অজ্ঞাতপরিচয়ের ওই তিন নারী ২৯ বছর বয়সী মাজেদ আব্দুল আজিজ আহমেদ নামের সৌদি যুবরাজের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করেন। ভুক্তভোগী তিন নারীর অভিযোগ, প্রিন্স মাজেদ যুক্তরাষ্ট্রের বেভারলি হিলস ম্যানসনের বাসায় তাদেরকে গৃহকর্মী হিসেবে নিয়োগ করবেন বলে জানান। পরে তাদের বাসায় নিয়ে আসার পর আটকে রেখে নিয়মিত যৌন নির্যাতন চালাতেন।
একইসঙ্গে বিভিন্ন পার্টিতে তাদের মাদক গ্রহণেও বাধ্য করা হতো। এ সময় গৃহকর্মীরা বাধা দিলে ভিডিও ফুটেজ ইন্টারনেটে ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে পাশবিক নির্যাতন চালাতেন। আরো অভিযোগ ছিলো, প্রিন্স গৃহকর্মীদের সুইমিং পুলে উলঙ্গ অবস্থায় নামিয়ে কোকেইন গ্রহণ করতেন। এই ঘটনার পরে সৌদি যুবরাজদের আরো অনেক যৌন কেলেঙ্কারি ও কুকীর্তির কথা সেসময় প্রকাশ হয়েছিলো।
যৌনতা মানুষের একটি প্রয়োজনীয় দৈহিক চাহিদা হলেও এটা চরিতার্থ করার জন্য পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি সভ্য সমাজে রয়েছে কিছু বিধিবদ্ধ নিয়ম। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে বার বার অনেক স্বনামধন্য ব্যক্তি এই যৌনতার ফাঁদে পড়েন আর এতে মুহুর্তেই তাদের সকল কীর্তি ম্লান হয়ে যায়। আধুনিকতার নামে আমরা সংস্কৃতির যেখানেই বর্তমানে অবস্থান করি না কেনো, পৃথিবীর সব দেশেই চরিত্রবান মানুষের গ্রহণযোগ্যতা এবং সম্মান সর্বোচ্চ। দিনশেষে চরিত্রবান মানুষকেই সবাই ভালোবাসেন, পছন্দ করেন।
References:
Post Views: 308
এই প্রবন্ধটা কি সাহায্যকর ছিল?
হ্যানা
মন্তব্য লিখুন